দিনের তৃতীয় সিগারেটটা শেষ করে সিগারেটের শেষ অংশটুকু বারান্দা থেকে বাইরের দিকে ছুড়ে দিল আশিক। নিচতলার বাসা। বাইরেরটা উঠোনের মত। ঢাকায় এরকম বাসা পাওয়া কঠিন। কলাবাগানের একটা চিপাগলির শেষ মাথায় বাসা। বাসার প্রধান ফটকে সুন্দর করে লেখা 'আব্দুল মান্নান'। এই বাড়ির মালিক। আসলে মালিক বললে ভুল হবে। মালিক ছিলেন। মান্নান সাহেব মারা গেছেন বহু বছর আগে। তিনি মারা যাবার পরও তার নামের সামনে মরহুম লাগানো হয়নি। এর পেছনে একটা ঘটনা আছে। আব্দুল মান্নান সাহেবের দুই পুত্র এই বাসাতেই থাকে। বাসার ভেতরে মূল ভবন ছাড়াও অনেকখানি জায়গায় জুড়ে আরো কিছু টিনশেড বাসা আছে। সেগুলোর মালিকানার দাবি এ দুই ভাই করতে পারে। মান্নান সাহেবের তিন কন্যা। তারা ঢাকাতেই থাকেন। কোন এক কারণে টিনশেড বাসাগুলোর ভাড়া তোলেন মান্নান সাহেবের মেয়েরা। এ নিয়ে ভাইদের সাথে বিবাদও আছে। তিন বোন প্রধান ফটকের নামের পরিবর্তন করতে দেননি। তাদের ধারণা বাবার নামে মরহুম শব্দ যোগ করলে তারা টিনশেড বাসাগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারাবেন। অথচ 'মুসলিম ল' বলে, পিতার মরহুম দশাই কেবল তিন মেয়ের স্থাবর সম্পত্তিতে ভাগিদারের বিষয়টিকে চূড়ান্তভাবে নিষ্পন্ন করতে পারে!
যাই হোক। আশিক লক্ষ্য করল, সিগারেটের টুকরাটা যেখানে পড়েছে সেখানে একটা বিড়াল বসে আছে। সিগারেটটা নেভানো হয়নি। মুখ ফিরে ঘরে ফিরতে যাবে এমন সময় আশিক যা অবলোকন করল তার সাক্ষী হয়ে রইল মহাকাল!
আশিক দেখল, বিড়ালটা সিগারেটটা সামনের দুই পা দিয়ে উঠিয়ে মুখে লাগিয়ে টানতে শুরু করেছে। যেন কোন অশরীরী আত্মা ভর করেছে বিড়ালটার উপর! আশিক নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করল আসলেই বিড়ালটা তাই করছে। এবার আশিক চমকে গেল। সে বাসার ভেতর থেকে বাধনকে ডাকল। বাধন এসেও অবাক হয়ে গেল। সিগারেট শেষ করে বিড়ালটা চলে গেল। আশিক বাসার সবাইকে ঘটনাটা বলল। বাসার বাকি সদস্য ফারিয়ান, নাফি আর আদি বিষয়টা বিশ্বাস করল না। তারা শুনেই উড়িয়ে দিল। আশিক ওদের অপেক্ষা করতে বলল। আবার বিড়ালটাকে দেখলে পরীক্ষা করে দেখাবে সে।
দিন চলে যায়। ছায়ানীড়-এর সবার মুহূর্ত কেটে যায় দ্রুত গতিতে। আশিক ওদের ফ্ল্যাটটার নাম দিয়েছে ছায়ানীড়। নিচতলা। সামনে আমগাছ। পেছনে জারুল গাছ দুইটা। বাসাটা নিচতলায় হবার কারণে ছায়াটাই বেশি। তাই এই নাম। পাঁচজন ব্যাচেলর থাকে তিনরুমের এ বাসাটায়। এর মাঝে একদিন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। আশিক শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। দরজায় নক হল। নাফি দরজা খুলে দেখে একটা বিড়াল। নাফিকে অবাক করে দিয়ে বিড়ালটা বলল, 'আশিক ভাই আছে বাসায়?' নাফি এক দৌড়ে বিছানার উপর। ও ঘর থেকে আদি আর ফারিয়ান আসল। তারা তাকিয়ে আছে। কোন কথা বের হচ্ছে না মুখ থেকে। বিড়ালটা আবার বলল, 'কি ভাই বলেন না কেন, আশিক ভাই আছে?' আশিক আসলো এবার। বিড়ালটাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হলেও তা চাপা রেখে ফারিয়ান, নাফি আর আদিকে আশিক জানাল, এটাই সেই বিড়াল। আশিকও খানিকটা চমকে গেছে। একটা বিড়াল সিগারেট খায় এটা মেনে নেওয়া যেতে পারে। তাই বলে কথা বলতে পারা বিড়াল!
আশিক বিড়ালটাকে বলল, 'কী চাস?' বিড়ালটা বলল, 'আশিক ভাই, একটা সিগারেট হবে?' আশিক বলল, 'আমার নামও জানস দেখি।' পরক্ষণেই বলল, 'তোকে কেন সিগারেট দিব?' বিড়ালটা বলল, 'তাহলে একটু খেয়ে বাকিটা দেন।' সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বিড়ালটার দিকে। আশিক বলল, 'আয় ঘরে আয়'।
বিড়ালটা ঘরে যেতে যেতে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, 'আমি মেরি। আর আপনাদের সবার নাম আমি জানি।' আশিক একটা সিগারেট ধরিয়ে বিড়ালটাকে দিল। মেরি মনের সুখে সিগারেট টানতে লাগল। চার-পাঁচটা টান দিয়ে আশিকের দিকে বাড়িয়ে দিল সিগারেটটা। আশিক ধমক দিয়ে উঠল, 'যাহ, তোর মুখে দেওয়া সিগারেট আমি খাব নাকি?'
সিগারেট খোর মেরি কোত্থেকে এসেছে কেউ জানে না। মাঝে মাঝেই সে এ বাসায় আসতে লাগল। আশিক না থাকলেও বাকিদের অনুরোধ করে ইনিয়ে-বিনিয়ে সিগারেট খায় মেরি। ইদানিং একটু বেশি আসে সে। বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিন। খাবার-টাবার কোনদিন চায় না। তবে বাসায় মাছ রান্না হলে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন আশিক বুঝতে পারে। এক টুকরা মাছ দিলেই কি যে খুশি! মাঝে মাঝে মনের সুখে গান ধরে মেরি, 'শুয়া চান পাখি আমার শুয়া চান পাখি... আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইসো নাকি...' কেউ খেয়াল না করলেও আশিক খেয়াল করে। বিড়ালটা ভালই গান গায়।
ফারিয়ান এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিবে। বাসার সবার ছোট সে। এতোদিন সবাইকে আপনি ডাকলেও একদিন মেরি ফারিয়ানকে তুমি করে বলল, 'ফারিবাবু, তোমার না পরীক্ষা। পড়তে বস না কেন?' ফারিয়ান ক্ষেপে গিয়ে বলল, 'আশিক ভাইকে বলে তোর সিগারেটের খাওয়া বন্ধ করে দিব হালার পুত। আমারে তুমি ডাকিস! এতোবড় আস্পর্ধা!'
একদিনের ঘটনা। বাসায় তিনজন ছিল। নাফি, ফারিয়ান আর আদি। বাঁধন মাছ কিনে দিয়ে গিয়েছে। বুয়া আসলে রান্না হবে। বুয়া আসলেন যখন, সূর্য তখন ঠিক মাথার উপরে। সকাল থেকেই মেরি ঘুরঘুর করছে। নাফি মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে যায় মেরির উপর। তখন ওকে বিরক্তির সুরে ডাকে 'ব্লাডি মেরি'। এতে মেরি যে খুব অখুশি হয় তাও না। সে নাফিকে বলে, 'ব্লাডি মেরি কি দিয়ে বানায় জানেন নাফি ভাই? ভদকার সাথে টমেটো সস, সাথে আরো আট দশ প্রকার মশলা দিয়ে শেইক করে বরফ কুচি মিশিয়ে!' নাফি মেরির জ্ঞান দেখে তাজ্জব বনে যায়। সে যাক। বুয়া আসার পর মেরি বলল, 'খালা, আশিক ভাই আমাকে দুই পিস মাছ দিতে বলসে।' বুয়া খেকিয়ে উঠল, 'আমারে খালা ডাকবি না কুত্তার বাচ্চা।' মেরি বলল, 'আহা এতো খেপতেসেন কেন? আর আমি কি কুকুর? আমিতো বিড়াল। বলেন আমারে খালা ডাকবি না বিড়ালের বাচ্চা!' বুয়া হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, 'আমি বিলাইয়ের খালা না। আমারে খবরদার খালা ডাকবি না। আইচ্ছা, রান্না করি, তারপর দিবনে তোরে মাছের পিস।' মেরি বলল, 'উহু, রান্না করা না। কাঁচা মাছ দেন দুই পিস।' বুয়া দুই পিস মাছ দিয়ে আপদ বিদায় করল।
রাতের বেলা এ ঘটনা শুনে খেপে গেল আশিক। ঘোষণা দিল, কাল থেকে মেরির এ বাসায় প্রবেশ নিষিদ্ধ। সিগারেট তো 'দূর কি বাত'। পরদিন এসে মেরি দেখল, তাকে কেউ ঢুকতে দিচ্ছে না। বাঁধন বাহিরে যাবার সময় মেরি পথ আটকালো, 'বাঁধন ভাই, আমি কি চুরি করে খাইসি? আমি তো বুয়ার কাছে নিসিলাম। প্লিজ আপনে আশিক ভাইরে বুঝায় বলেন।' বাঁধন কিছুই না বলে পাশ কেটে চলে গেল। নাফি খুব খুশি। বেয়াদব বিড়ালটা আর বাসায় আসবে না। আগে থেকেই মেরিকে সে পছন্দ করে না। শুধুমাত্র আশিক ভাইয়ের জন্য ওকে সহ্য করে এসেছে এতোদিন।
কিছুদিন পর কীভাবে যেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেল। দেখা গেল, মেরি নিয়মিত বাসায় আসে। মাঝে মাঝে আশিকের সাথে সিনেমাও দেখে কম্পিউটারের সামনে বসে। সিগারেট খায় একসাথে। মাঝে মাঝে রাতে থেকেও যায়। আশিকের বিছানার নিচে। সকালবেলা ম্যাও ম্যাও করে ফারিয়ানকে ডেকে দেয়। আজ সে ফারিয়ানকে তুই বলে সম্বোধন করেছে, 'ওই ফারিয়ান, উঠস না ক্যান? পরীক্ষা তো আজ বাদ কাল। পড়াশোনা নাই। খালি ঘুম।' ফারিয়ান বিছানা থেকে ঘোষণা দিয়ে বলল, 'আজ সারাদিন তোকে যদি একবার দেখি, তাহলে তোর একদিন কি আমার একদিন।' এ শুনে মেরি একটু ভয় পেলেও তা প্রকাশ করল না। সারাদিন ফারিয়ানকে এড়িয়ে চলল সে।
সন্ধ্যাবেলা আশিক ফিরল। ফ্রেশ হয়ে একটা সিগারেট ধরাল। বিছানায় এসে বসল মেরি। আশিক সিগারেট বাড়িয়ে দিল মেরির দিকে। সিগারেটে টান দিয়ে মেরি জানালা দিয়ে দূরে তাকিয়ে উদাশ ভঙ্গিতে বলল, 'আশিক ভাই, কী আছে জীবনে?' আশিক বলল, 'কেন? প্রেম করতেসিস নাকি?' মেরি বলল, 'প্রেম একবার এসেছিল নীরবে!' আশিক হেসে ফেলল। বলল, 'লতা মঙ্গেশকরের গানের লাইনও জানিস দেখি!' মেরি বলল, 'ওই যে বললাম না, কী আছে জীবনে?!' আশিক মাঝে মাঝে অবাকই হয়, একটা বিড়ালের সাথে সে সিগারেট খায় প্রতিদিন। বিড়ালটা কথাও বলে। কি আজীব! পরক্ষণে আশিকেরও মনে হল 'কী আছে জীবনে!'
পরদিন সকালবেলা তড়িঘড়ি করে আশিক অফিসে চলে গেল। বাসার সবাই যে যার মত ব্যস্ত। কেউ খেয়াল করল না, আজ বিড়ালটা আসেনি! সন্ধ্যাবেলা আশিক ফিরবার পথে মাছ কিনে আনল। বেচারা মেরি কোথায় কি খায় কে জানে। আজ ওকেই দুই পিস মাছ আগে দিবে। বাসায় এসে আশিক শুনল মেরি আজ আসেনি। আশিক বলল, 'কাল ঠিকই আসবে, যাবে আর কোথায়?'
তার পরদিন গেল। তারও পরের দিন গেল। মেরি আসল না। ছায়ানীড়ের সবার মনে কেমন যেন একটা প্রচ্ছন্ন ছায়া নেমে আসল। নাফিই প্রথম বলল, 'আশিক ভাই, মেরি কই থাকে জানেন কি?' আশিক বলল, 'ও তো এখানেই থাকতো। আশেপাশেই মনে হয়।' ফারিয়ান বলল, 'চলেন বাঁধন ভাই খুঁজি আশেপাশে।' বাঁধন, ফারিয়ান, নাফি মিলে বাসার আশেপাশে খুঁজতে শুরু করল মেরিকে। কিছুক্ষণ পরে যোগ দিল আশিক আর আদিও। তন্ন তন্ন করে গোটা এলাকাটা খুঁজেও বিড়ালটাকে পাওয়া গেল না।
গাঢ় বিষাদে ঢেকে গেল পাঁচজন মানুষের মন। সামান্য একটা বিড়ালের জন্য ছায়ানীড়ে বেজে উঠল নৈরাশ্যের মর্মস্পর্শী সুর। ওরা নিজেরাও অবাক হল, একটা মাত্র বিড়ালের জন্য ওদের এতো খারাপ লাগছে কেন?! আশিক মৃদু শব্দে বলল, 'যেখানেই থাকিস, ভালো থাকিস মেরি।'
সময় যেতে থাকল। ছায়ানীড়ের সবাই মেরিকে ভুলে যেতে থাকল। শুধু আশিক যখন সিগারেট খায় তখন মেরির কথা মনে পড়ে। আশিক মনে মনে হাসে। মাঝে মাঝে মায়া হয় মেরিটার জন্য। কে জানে কোত্থেকে এসেছিল ওটা! তো এরই মাঝে ফ্রান্স থেকে একটা চিঠি পেল আশিক। চিঠিটা বাংলায় লেখা। খুব কাঁচা হাতের লেখা। আঁকাবাঁকা। বোঝাই যাচ্ছে অপরিপক্ক হাত। আশিক পড়তে শুরু করল,
প্রিয় আশিক ভাই,
আপনাদের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। সেদিন রাতে আপনার সাথে গল্প করার সময় আপনাকে বলছিলাম আমার মনের কথাটা। ফ্রান্সে আসার কথাটা বলার পরে দেখি আপনি ঘুমিয়ে গেছেন তাই ডাকিনি আর!
এখানে ভালই আছি। আপনাদের মত মানুষ এখানে খুঁজে পাইনি অবশ্য। তবে একজন আছে যে মাঝে মধ্যে সিগারেট দেয়। তার নাম অ্যাভেলিনো। তাকে আপনার কথা বলেছি। আর এটাও বলেছি, আপনার মত মানুষ আমি আর দেখি নাই! নাফি ভাইকে বলবেন, মধুসূদন দত্ত যেমন নামের সামনে 'মাইকেল' লাগিয়েছিলেন আমিও এখানে এসে নামের সামনে 'ব্লাডি' যোগ করেছি।
ইতি,
ব্লাডি মেরি
পুনশ্চঃ এখানকার মাছ বেশি ভালো লাগে না।
আশিক পড়া শেষ করে মনে মনে হাসল। ভাবল, 'কী আছে জীবনে!'
[ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর 'বিড়াল' গল্প থেকে অনুপ্রাণিত ]
ব্লগ | হিউম্যানস অব ঠাকুরগাঁও-এ প্রকাশিত সকল লেখা এবং মন্তব্যের দায় লেখক-ব্লগার ও মন্তব্যকারীর। কোন ব্লগপোস্ট এবং মন্তব্যের দায় কোন অবস্থায় 'ব্লগ | হিউম্যানস অব ঠাকুরগাঁও' কর্তৃপক্ষ বহন করবে না
আসিফ আহমেদ
March 08, 2017 06:22 AM , ৬ বছর পূর্বেMar 08, 2017 11:06 AM , ৬ বছর পূর্বে