যেটা বলতে চাইছি, সেটা হলো এখানে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মান বিচার করে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখক সত্ত্বা নিয়ে দুটো কথা বলব।
বঙ্গবন্ধু প্রায় গুনে গুনে চুয়ান্ন বছর বেঁচে ছিলেন। এর মাঝে ১০০০০+ দিন তাকে জেলে কাটাতে হয়েছে নানান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। এই দীর্ঘ বিচ্ছিন্ন সময়গুলো তিনি কাজে লাগিয়েছেন লেখালেখি করে। ২০১২ সালে আমরা হাতে পাই 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' বইটি। আমার মনে হয়েছে, এই বইটি একবছর সময় নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়া উচিৎ। এবং এটি বাংলাদেশের রাজনীতির 'বাইবেল' ছাড়া আর কিছু নয়। শব্দের গাঁথুনি আর বক্তব্য উপস্থাপন দেখে মনে হয়েছে, তিনি অন্য কিছু করতেন না, একজন পুরোদস্তুর লেখক এবং এর আগে ডজনখানেক বই বাজারে বের করেছেন! লেখার প্রয়োজনে অনেক রাজনৈতিকের নাম এসেছে। এই বইয়ে খন্দকার মোশতাকের সম্পর্কেও দুটো ভালো কথা বলা আছে! তাঁর রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দি সাহেবের বিষয়ে সবটুকু আবেগ দিয়ে লিখেছেন বঙ্গবন্ধু। ভাষা আন্দোলনের সময় শেখ মুজিবের ভূমিকা স্পষ্ট করে লেখা আছে এতে। সাম্প্রতিককালে সাড়া ফেলে দিবার কারণে আরও ছয়টি ভাষায় অনূদিত হয় 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' বইটি।
একই বইয়ে আমরা খুঁজে পাই তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অবর্ণনীয় কষ্টগুলো, দেখা যায় রাজনৈতিকের লেখকসুলভ রসবোধ। তিনি এই পুস্তকের শুরুতেই নিজের জীবনের বর্ণনা দিয়েছেন এমনভাবে যা পাঠককে আটকে রাখে। আবার একবার নৌকায় যাবার পথে ডাকাতের আক্রমণের স্বীকার হলে সেখানে ডাকাতরা 'শেখ সাহেব'-কে তাদের দলের কোনো ডাকাত ভেবে যে সসম্মানে ছেড়ে দিয়েছিল, তা নিয়ে কৌতুক করতেও ছাড়েননি!
২০১৭ সালে এসে আমরা হাতে পেলাম তাঁর আরেকটি বই- 'কারাগারের রোজনামচা'। বাংলা একাডেমি থেকে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে বের হয়েছে বইটি। বইটা শুরুর স্টাইলটাই অসাধারণ। কোন অংশে লেখক কারাবন্দীদের জীবনের দুঃখগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন আপন লেখনি দিয়ে, আবার কিছু জায়গায় শ্লেষাত্মক ভঙ্গি ফুটে ওঠে লেখকের বাস্তবলব্ধ অভিজ্ঞতায়। জেলের ভেতরের পরিভাষা, নিয়মকানুনের যে সামুদ্রি মানচিত্র নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি তুলে ধরেছেন, তা আর কোনো কারা বিষয়ক সাহিত্যে দেখা যায় না। দুঃখকষ্টের কথা বলেছেন জেলের ভেতরের, তার সাথেই আবার রান্নাবান্না, বাগান করা, অন্য রাজবন্দী-কারাবন্দীদের খোঁজখবর নেওয়া এবং ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদের জন্য কয়েদিদের স্বভাব, আচরণের যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিবরণ তুলে এনেছেন, তা সত্যিই বিস্মিত করে 'কারাগারের রোজনামচা' পড়বার সময়।
অচিরেই বের হচ্ছে তাঁর 'নয়াচীন' নামের আরেকটি বই। উল্লেখ্য, অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেই শান্তি সম্মেলনে চীন সফরের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন শেখ মুজিব। তবে পরবর্তীকালে এ বিষয়ে তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপি রচনা করে গেছেন। ভাবতে অবাক লাগে, বিপুল পরিমাণে রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞের মধ্যে ব্যস্ত থেকেও তিনিও লিখে গেছেন কত যত্ন সহকারে! তাঁর লেখার বৈঠকি চালটা কাছে টানে পাঠককে সবথেকে বেশি।
নয়াচীন নামে বইটিও প্রকাশিত হবে বাংলা একাডেমি থেকে। এই বইটির অপেক্ষায় থাকলাম। আর মাঝে মাঝে খুব মনে হয়, তিনি যদি বেঁচে থাকতেন (এবং লেখালেখির অভ্যাসটা অবিরত রাখতেন), তবে আমরা বাংলা সাহিত্যে আরেকজন প্রবাদপুরুষ পেতাম! আফসোস!
ব্লগ | হিউম্যানস অব ঠাকুরগাঁও-এ প্রকাশিত সকল লেখা এবং মন্তব্যের দায় লেখক-ব্লগার ও মন্তব্যকারীর। কোন ব্লগপোস্ট এবং মন্তব্যের দায় কোন অবস্থায় 'ব্লগ | হিউম্যানস অব ঠাকুরগাঁও' কর্তৃপক্ষ বহন করবে না
মোহাম্মদ মাহির আবরার
March 31, 2018 10:33 PM , ৪ বছর পূর্বেApr 04, 2018 04:57 PM , ৪ বছর পূর্বে